মাদারীপুর মিউজিয়াম

জাদুঘর সমাজের দর্পণ। জাদুঘর জাতির শেকড় সন্ধান করে। মাদারীপুর জাদুঘর-বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশাল সংগ্রহভাণ্ডার। এই সমৃদ্ধ সংগ্রহের মাধ্যমে জাদুঘর জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তাই জাদুঘর বর্তমানে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়।
মাদারীপুর মিউজিয়াম ইতিহাস সংরক্ষণের এক অনবদ্য প্রতিষ্ঠান। মাদারীপুর জেলা বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ। এ জেলার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ ১৯৭১ খ্রি. এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর জেলার রয়েছে অসামান্য গৌরোবজ্জ্বোল অবদান। অত্যন্ত প্রাচীন ও ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চল হলেও মাদারীপুর জেলা বা এর সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে এই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। ফলশ্রুতিতে সময়ের পরিক্রমায় অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন, ঘটনাবলী ও দৃষ্টান্ত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনাগত প্রজন্মকে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করতে জাদুঘর হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যমগুলোর একটি।

মাদারীপুর জেলায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবী অনেক আগে থাকে। ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জেলাতে ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় জেলার সচেতন নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই জেলার অবদান সংরক্ষণের দাবীকে সামনে রেখে মাদারীপুর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরাতন ট্রেজারি ভবনে এই জাদুঘর অবস্থিত। মাদারীপুর জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ভবনটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয়।বিশেষত মাদারীপুর জেলায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত ও তৎকালীন মহকুমা ট্রেজারি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো মাদারীপুর জেলাতেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকগণ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাবে প্রশিক্ষণ শুরু করা যাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত এগিয়ে আসেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র তুলে দেন।

প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেজারি হতে অস্ত্র নিয়ে যেতেন ও প্রশিক্ষণ শেষে ট্রেজারিত অস্ত্র রেখে যেতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মহকুমা প্রশাসকের এই সাহসী ভূমিকার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা নিয়ে যায় ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। একই সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রেজারি ভবন দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই ভবন পুনরায় ট্রেজারি ভবন হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জেলা কালেক্টরেট শকুনী লেক পাড় হতে স্থানান্তরিত হয় প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বর্তমান স্থানে চলে যায়, ফলে জেলা ট্রেজারি নতুন কার্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়। কালক্রমে পুরাতন ট্রেজারি ভবন পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয় ও বেদখল হয়ে যায়। এই ভবন সংরক্ষণের জন্য অনেক আগে থেকেই মাদারীপুর জেলার সচেতন নাগরিক সমাজের মধ্যে দাবী উঠেছিল। ৩১ মার্চ ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন এর সার্বিক নির্দেশনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো: নাজমুল ইসলাম এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসনের জাদুঘর স্থাপনের ফলে ভবনটিকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
ইতোমধ্যে মাদারীপুর মিউজিয়াম এর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়েছে। ট্রাস্টি সদস্য হিসেবে মাদারীপুর জেলার প্রথিতযশা কৃতিব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ জাদুঘর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে অগ্রগণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই মিউজিয়ামে ইতোমধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন এর শতাধিক চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া জেলার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থান পেয়েছে। জাদুঘরের জন্য উপকরণ সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে জাদুঘরটি বুধবার থেকে সোমবার বিকাল ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।